দীপালোক বন্দ্যোপাধ্যায় ; কলকাতা, ২৬ এপ্রিল, ২০২৬। একে বাংলায় বলা যেতে পারে হিমায়িত কাঁধ বা আঠালো ক্যাপসুলাইটিস ৷ আমাদের কাঁধ হল হিউমারাস ( উপরের বাহুর হাড়) , স্ক্যাপুলা ( কাঁধের ফলক) ও ক্ল্যাভিকেল (কলারবোন) এই তিনটি হাড় নিয়ে গঠিত একটি ‘বল ও সকেট জয়েন্ট’ ৷ হিউমারাসের মাথাটি কাঁধের ব্লেডে একটি অগভীর সকেটের মধ্যে বসে থাকে ৷ এই সন্ধি বা জয়েন্টটি কাঁধের ক্যাপসুল নামের বেশ শক্তিশালী সংযোগকারী
কোষ বা টিস্যু দিয়ে বেষ্টিত ৷ কাঁধের চলন ঐ পেশীগুলিকে রোটেটর বলে যা বাহু , বুক ও পিছনের পিঠের অন্য পেশীগুলির সঙ্গে কাজ করে ৷ সহজে যাতে চলাচল করা যায় তাই সাইনোভিয়াল ফ্লুয়িড নামের তরল কাঁধের ক্যাপসুল ও জয়েন্ট উভয়কেই লুব্রিকেন্ট করে ৷
ফ্রোজেন শোল্ডার মানে কাঁধের কব্জাটি জমে Frozen বা আড়ষ্ট হয়ে যাওয়া বা আটকে যাওয়া ৷ সাইনোভিয়াল ফ্লুইড বা আবরণ সঙ্কুচিত হতে থাকে ৷ এটা একটা লক্ষণ ৷ দীর্ঘকাল কাঁধ নড়াচাড়া না করলে জয়েন্ট শক্ত হয়ে যায় ৷ আবার জয়েন্টে রক্ত প্রবাহ কমে গিয়ে মাংস পেশী দূর্বল হয়ে যায় ৷ এর ফলে কাঁধে ব্যথা হয় ৷ রোজকার কাজকর্মে বাধা সৃষ্টি করে ৷ প্রধান লক্ষণ ব্যথা ৷ মোট জনসংখ্যার ২-৫ ভাগ ৷ আর ৩৫- ৬৫ বছরের মহিলাদের মধ্যে ৭০% এডহেসিভ ক্যাপসুলাইটিস( AC) বা পেরিয়ার্থারাইটিস রোগের শিকার ৷ বিভিন্ন সময় পুরুষদের চেয়ে মহিলাদের মধ্যে চার গুণ এই রোগ হতে দেখা যায় ৷ যাদের অতিরিক্ত চর্বি বা হাইপারলিপিডিমিয়া , হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ইতিহাস আছে বেশী হয় ৷ প্রথমে কাঁধের চারপাশে অল্প ব্যথা হয় ৷ এই ব্যথা ধীরে ধীরে শুরু হয়ে
যত দিন যায় ব্যথা বাড়ে ৷ রাতে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে ৷ দ্বিতীয় লক্ষণ হাতের আড়ষ্টতা ৷ চুল আঁচড়াতে , পিঠ চুলকাতে , দড়িতে জামাকাপড় মেলতে , ট্রেনে , বাযে হাতল ধরতে , বল ছুড়তে , প্যান্টের পিছনের পকেট থেকে মানি ব্যাগ বের করতে কষ্ট হয় ৷ পরে হাতের পেশি দূর্বল হয়ে পড়ে ৷ হাতের জোর কমে যায় ৷ এই রোগের জন্য রোটেটর কাফ টিয়ার ও টেনডিনাইটিস , বাইসেপস ও ক্যালসিফিক টেনডিনাইটিস ও এক্রোমিওক্ল্যাভিকুলার আর্থ্রাইটিস দায়ী হতে পারে ৷
ফ্রোজেন শোল্ডার হওয়ার অধিকাংশ কারণ বোঝা যায় না ৷ তবে , বয়স্ক মানুষ , ডায়াবেটিস , হার্টের অসুখ , পারকিনসন , হাইপোথাইরয়েডিজম , হাইপোথায়রেডিজম , ক্যান্সার রোগ সহ কোমরবিডি থাকলে বেশি দেখা যায় ৷ চোট বা আঘাত লেগে , ফুসফুস , হৃদপিন্ড ও হাতের অপারেশনের পর এবং বিভিন্ন সংক্রমণ থেকে রোগটি হতে পারে ৷ রোগটি দীর্ঘমেয়াদী ৷ সারতে সময় লাগে ৷ তাই ধৈর্য ধরে ব্যায়াম ও চিকিৎসা চালাতে হয় ৷ এক কাঁধ থেকে অন্য কাঁধে পাঁচ বছরের মধ্যে হতে পারে ৷ ফ্রোজেন শোল্ডারের তিনটি পর্যায় ৷ শুরুতে Freezing Stage – ব্যথা বৃদ্ধি হয় ও কাঁধ শক্ত হয় ৷ স্থায়ী পর্যায় -Frozen Stage – এই অবস্থায় ব্যথা সামান্য কমলেও কাঁধ শক্ত ও অনড় হয়ে যায় ৷ তৃতীয় পর্যায়ে উন্নতি হতে থাকে – Thawing Stage – এই সময় ধীরে ধীরে কাঁধের নড়চড়া স্বাভাবিক হতে শুরু করে ৷ তাই প্রত্যেকের উচিত দীর্ঘসময় কাঁধ স্থির না রেখে নড়াচড়া করা ৷ রোজ কিছুক্ষণ হালকা ব্যায়াম ও স্ট্রেচিং করা ৷ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে হাত সামনে পিছনে দোল খাওয়ানো , দু হাত দুপাশে কাঁধের সমান্তরালে মেলে ডানা ঝাপটানো , দু হাত কাঁধের সমান্তরালে সামনের দিকে মেলে ধীরে ধীরে ডানা মেলা , এক লিটার জল ভরা বোতল নিয়ে হাত এ পাশ থেকে ও পাশ করা , ছাদে বা গাছে দড়ি ঝুলিয়ে পুলি টানার মত এক হাত ওঠান অন্য হাত নামান , দেওয়ালের দিকে মুখ করে এক আঙুল এক আঙুল করে দেওয়াল বেয়ে হাত ওঠানো , শরীর যেন দেওয়ালে সেঁটে থাকে , চিৎ হয়ে শুয়ে হাত কানের পাশ বরাবর মাথার দিকে দেওয়া এসব ব্যায়াম উপকার দেয় ৷ আঘাত লাগলে ও অপারেশনের পরেও কাঁধকে কর্মক্ষম রাখার ব্যায়াম করতে হবে ৷ এই রোগে ফিজিওথেরাপি ও ব্যায়াম সবচেয়ে কাজে আসে ৷ সাধারণ ভাবে নারকেল তেল ও রসুন কিংবা নারকেল বা তিলের তেলের সাথে কর্পূর গরম করে পেক্টোরালিস ও ডেল্টয়েড পেশীতে মালিশ করলে কাঁধের ব্যথা কিছুটা উপশম হয়ে গতির পরিসীমা অনেকটা বাড়ে ৷ গরম দুধে ৩-৪ কোয়া রসুন কুচি গুঁড়ো করে রোজ সকালে খাওয়া ভাল ৷ ফিজিওথেরাপি – যেমন শক ওয়েভ থেরাপি , টেনস , আল্ট্রাসাউন্ড , আই আর আর , ভাইব্রেশন , তাপ ,টেপিং স্পাইডার , পুলি ও পেন্ডুলার এক্সারসাইজ , নরম টিস্যু চিকিৎসা , ইন্টার ফেরেন্সিয়াল থেরাপি নামের একরকম ইলেক্ট্রিকাল স্টিমুলেশন ও ম্যানুয়াল থেরাপি ৷ ব্যায়াম – মোবিলাইজেশন , স্ট্রেচিং ও মোবিলিটি এক্সারসাইজ , থেরাব্যান্ড ও বেঞ্জ অব মোশন করা দরকার ৷ আকুপাংচার , হাইড্রোথেরাপিতেও উপকার হয় ৷ আকুপাংচারে যেখানে স্নায়ু ও পেশী মিলিত হয় সেই টান স্পট এবং মায়োফেসিয়াল ট্রিগার পয়েন্টে আকুপাংচারের সূঁচ প্রবেশ করিয়ে পেশী নরম ও শিথিল করে ব্যথা কমানো হয় ৷ এভাবে স্নায়ুগুলিকে উদ্দীপিত করে সেরোটোনিন হরমোন ও এন্ডোরফিন নামের প্রাকৃতিক ব্যথা নাশক
রাসায়নিক নির্গত হয় ৷ এতে কাঁধের এলাকায় সরবরাহকারী শিরা ও ধমনীগুলির ব্যাস এবং রক্ত প্রবাহের বেগ বেড়ে ওখানকার মাইক্রোসার্কুলেশন উন্নত করে ৷ সপ্তাহে দু একবার করে মাস খানেক করলে অবস্থার বেশ উন্নতি হয় ৷ ইউনানী চিকিৎসা পদ্ধতিতে
সুরঞ্জন , বোজিদান , মুকিল নামের একক বা সিঙ্গল মেডিসিন এবং মাজুন ছোবাচিনি , হাব্বে অগন্ধ , হাব্বে মুকিল ইত্যাদি খেতে দেওয়ার পাশাপাশি তাকমীন বা ফোমেন্টেশন , হিজামত বিলা শর্ট , ফাসাদ প্রভৃতি ব্যবহার করে এডেসিভ ক্যাপসুলাইটিস সারানো হয় ৷
গরম ও বরফ ঠান্ডা সেঁক ব্যথা কমায় ৷ ব্যথা বেশি হলে
প্যারাসিটামল , আইবুপ্রোফেন , ন্যাপ্রোক্সেনের মত নন স্টেরয়ডাল ইনফ্লামেটরি ড্রাগ নিতে হয় ৷ কোন কোন ক্ষেত্রে ইনফ্লামেশন কমাতে ঐ জায়গায় ৭-১০ দিনের ব্যবধানে ৩-৪টি স্টেরয়ড ইনজেকশন দিতে হয় ৷ সঙ্গে ব্যায়াম চালাতে হয় ৷ ডায়াবেটিক রোগীদের ঐ ইনজেকশন দিতে নেই ৷ অবস্থা খুব খারাপ হলে হাইড্রোডাইলেটেশন , ম্যানিপুলেশন ( অজ্ঞান করে খুব সাবধানে চিকিৎসক কাঁধের সন্ধিকে ঘুরিয়ে দেন )আন্ডার এনাসস্থেশিয়া( MUA) দিতে হয় ৷ একবারে জটিল অবস্থায় কাঁধে ছোট ফুটো করে আর্থ্রোস্কোপ নামের একটি পাতলা টিউবের সঙ্গে সংযুক্ত একটি ছোট ক্যামেরা ব্যবহার করে আরথ্রোস্কোপিক সার্জারী করে কঠোর টিস্যু কেটে ফেলতে হয় ৷ হোমিওপ্যাথিতে স্যাঙ্গুনেরিয়া ক্যান , লিডাম পল , ফেরাম মেট , রাস টক্স , গুয়েকাম , ব্রাইয়োনিয়া , কস্টিকাম , রুটা ,ফেরাম ফস ইত্যাদি ওষুধ লক্ষণ অনুসারে দেওয়া হয় ৷ এতে রোগী আরাম পায় ৷ আয়ুর্বেদে এই রোগের নাম ‘আবাহুকা’ ৷ এখানে এই বাত ব্যধির তিনটি কারণ বলা হয়েছে – অভিঘাত বা ট্রমা , অহরাজাম অর্থে খাদ্যের উপাদান ও বিহারজম বা লাইফস্টাইল দায়ী ৷ আয়ুর্বেদে এই রোগে মাথা থেকে পা পর্যন্ত ওষুধি তেল দিয়ে মালিশ করা হয় ৷ এই ‘অভয়ঙ্গম’ পদ্ধতিতে ব্যথা কমে , স্নায়ু কার্যক্ষমতা ফিরে পায় ৷ ‘নাস্যম’ পদ্ধতিতে ওষুধ যুক্ত তেল বা গুঁড়ো নাকের ফুটোয় দেওয়া হয় ৷ মস্তিষ্কের ব্যথা নাশক অংশে কাজ করে ব্যথা নাশ করে ৷ স্নেহা ও কাশয়া ‘বস্তি’ তে ওষুধি ক্কাথ এনিমা করে রোগ মুক্ত করা হয় ৷
ফ্রোজেন শোল্ডারের রোগী আজকাল ঘরে ঘরে আমার চল্লিশ বছরের চিকিৎসক জীবনের অভিজ্ঞতায় আমি এমন বহু শারীরিক রোগ নিয়ে ” রোগ পরিচয় ” এবং মানসিক নানা সমস্যা নিয়ে “মন” নামের বই দুটি লিখেছি ৷
ছবি সৌজন্যে- গুগুল।