সুদীপা চৌধুরী : মেদিনীপুর, ২১ অক্টোবর , ২০২৫। আমরা যখন কালীপুজোর ব্যস্ততায় দিনযাপন করি লাল মাটির দেশে শাল-পিয়াল-মহুল ঘেরা আদিবাসী গ্রামগুলিতে তখন
বাঁদনা উৎসবের আমেজ। প্রতি বছর কালীপুজো থেকে শুরু হওয়া এই পরবকে ঘিরেই মেতে ওঠেন রাঢ় বাংলার আদিবাসীরা। হেমন্তের এই এলোমেলো আবহাওয়ায় মিশে থাকে তাদের সুরেলা বাঁদনা গান।
সাঁওতাল, মুন্ডা, নাপিত ,কুড়মি, শোনা ইত্যাদি জনগোষ্ঠীর কাছে এই উৎসব আজও ঐতিহ্যের। বড় আপনার উৎসব এটি তাদের। ছোটনাগপুর মালভূমি সহ, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া ও পশ্চিম মেদিনীপুরের একটি বড় গ্রামীণ উৎসব এটি। তবে কিছু কিছু জায়গায় পৌষ মাসেও এই উৎসব পালন করা হয়।
মূলত গো-বন্দনাই হল এই উৎসবের মূল বিষয়। কার্তিক মাসের অমাবস্যা তিথিতে কালীপুজোর দিন থেকেই এই উৎসবের সুচনা হয় । তা চলে টানা এক মাস ধরে। জঙ্গলঘেরা আদিবাসী গ্রামগুলিতে কোথাও তিনদিন, আবার কোথাও বা পাঁচদিন ধরে চলে বাঁদনা পরব। এক একটি গ্রামে উৎসবের দিন ঠিক করে দেন সেই গ্রামেরই মোড়ল। উৎসবের জন্য আদিবাসী মহিলারা তাঁদের মাটির ঘর নানান রঙের প্রলেপ দিয়ে রাঙিয়ে তোলেন। বাকল দিয়ে মসৃণ করে তোলেন ঘরের দেওয়াল। সেই সঙ্গে দেওয়ালে এঁকে দেন আলপনা। এই সময় বাড়ির পুরুষেরা ব্যস্ত থাকেন গরু, মোষের সেবা-যত্নের কাজে। একনাগাড়ে জমিতে কৃষিকাজ করার পর এই সময় বিশ্রাম পায় গবাদি পশুরা। পেট ভর্তি খাইয়ে তাদের মাঠে চরানো হয়।
গোয়াল ঘর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে, গরু মোষের সিং এ তেল মাখিয়ে দেওয়া হয়। শরীরে রঙের ছাপ দিয়ে তাদের গলায় মালা আর শিংয়ে ধানের শীষের গোছা পরিয়ে বরণ করাই হল উৎসবের রীতি। অমাবস্যার দিন বিকেল থেকেই প্রতিটি আদিবাসী ঘরে গরু-বলদকে গোয়ালে রেখে পুজো করা হয়। তারপর সারারাত ধরে চলে গরু জাগানোর গানবাজনা। পুরুষেরা অমাবস্যার রাতে দল বেঁধে প্রতিটি ঘরে গরু জাগানো গান গায়। উৎসবের প্রথম দিনে আদিবাসীরা তাদের দেবতার উদ্দেশে পুজো দেয়। সন্ধ্যা থেকে ধামসা-মাদলের ‘ধিতাং ধিতাং বোলের’ সঙ্গেই শুরু হয় নাচগান। উৎসবের দ্বিতীয় দিন হয় গরু খোঁটানো। গ্রামের ফাঁকা মাঠে খুঁটির সঙ্গে শক্ত করে বাঁধা হয় গরু-মহিষকে। এরপর চামড়া আর লাল কাপড় হাতে নিয়ে তাদের দিকে এগিয়ে যান আদিবাসী পুরুষেরা। উত্তেজিত গরু-মহিষ বেরিয়ে আসতে চায় খুঁটি ছিঁড়ে। অনেকটা ‘বুল ফাইটের’ মতো দেখতে লাগে এই গরু খোঁটানো। পরব দেখতে শ’য়ে শ’য়ে আদিবাসীর ভিড় জমে গ্রামের মাঠে।
এই উৎসবে ঘটা করে আমন্ত্রণ জানানো হয় আদিবাসী পরিবারের মেয়ে-জামাইকে। উৎসবে তাদের নতুন বস্ত্রও দেওয়া হয়।কালীপুজোর অমাবস্যা থেকে শুরু হয়ে উৎসবের রেশ থাকে রাস পূর্ণিমার দিন পর্যন্ত। শস্য, সন্তান আর গবাদি পশুকে রক্ষা করার জন্য বাঁদনা-উৎসবে মেতে ওঠে রাঢ় বাংলার আদিবাসী সমাজ। এই উৎসবে যে গান গাওয়া হয় লৌকিক ভাষায় তাকে অহিরা গান বলে।
মানুষের সাথে সাথে পশুর প্রতি যত্নবান ভালোবাসা দেখানোর রীতি বোধহয় বহু আগে থেকেই গ্রাম বাংলার ঘরে ঘরে গাঁথা ছিল। যে গবাদি পশুরা গোটা বছর কৃষিকাজে সাহায্য করে দুধ দিয়ে সাহায্য করে, তাদেরও তো বিশ্রামের প্রয়োজন। প্রয়োজন তাদের একটু কৃতজ্ঞতার একটু ভালোবাসার আর তার নিদর্শন বোধহয় এই বাঁদনা পরব। কত উচ্চ চিন্তা ভাবনা আমরা মানুষকে ভালবাসতে মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞতা দেখাতে কুণ্ঠিত বোধ করি ,ইগোর লড়াই এ সর্বদাই এগিয়ে থাকতে চাই, সেখানে এই আদিবাসী গোষ্ঠী যেখানে শিক্ষা আজও অধরা তারা কিন্তু নির্দ্বিধায় পশুদের কে পুজো করে চলে। পুঁথিগত শিক্ষার থেকে নীতিগত শিক্ষা বোধহয় অধিক মূল্যবান । আমরা সামান্য একটা সারমেয় কিংবা বিড়ালকে ঘরে আনলে হাজারবার তার ছবি দিই তাকে, নিয়ে কত কথা লিখি অথচ এই মানুষেরা কত প্রাচীন সময় থেকে গবাদি পশুদের ভালোবেসে পূজা করে চলেছে কিংবা যত্ন করে চলেছে তারা কিন্তু কোন মিডিয়ার প্রচার কিংবা লোক দেখানোর জন্য উদগ্রীব নয়। একটু শীতের রাতে যেখানে পৌষ মাসে এই বাঁদনা পরব হয়, বা এখনো ফ্যানের আওয়াজ শহরের গাড়ি ঘোড়ার আওয়াজ বন্ধ হলে দূর থেকে তাদের গানগুলো শোনা যায়, অদ্ভুত মায়াবী গান, অদ্ভুত সুর। আকৃষ্ট করে মনকে। প্রচার বিমুখ এই লৌকিক উৎসব গুলো কিংবা গাঁথাগুলো অবহেলিত বড্ড। খুব সুন্দর লাগে দেখতে তাদের নিকোনো উঠোন সুন্দর করে সাজানো এই মাটির বাড়িগুলো, মনে হয় যেন শহরের ইট কাঠ পাথরের যান্ত্রিক জীবন তুচ্ছ করে ছুটে চলে যাই প্রকৃতির কোলে নির্মল বাতাস নিয়ে মিশে যাই, ঐ অজানা অচেনা গ্রাম্য মানুষদের ভিড়ে।।


